মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
পুরনো ঢাকার মিটফোর্ডে যখন ব্যবসায়ী লাল চাঁন সোহাগকে দিনের বেলা প্রকাশ্যে পাথর আর ইট দিয়ে হত্যা করা হয় তখন সেখানে অনেক মানুষ ছিলেন৷ আশপাশের দোকানে ব্যবসায়ীরা ছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধার বা রক্ষায় এগিয়ে যায়নি৷ সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ ওই ঘটনার ভিডিও করেছেন৷ দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার পর মিটফোর্ড হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসাররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। যে আসামীরা ধরা পড়েছে তাদের একজনের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে৷ তাকে প্রশ্ন করা হয় এমন নৃশংসভাবে মানুষ কি মানুষকে হত্যা করে? সেখানে তার জবাব ছিলো: ‘‘এরচেয়েও নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ এটা তেমন কিছু না।''
সোহাগ হত্যাকাণ্ড বুধবার ৯ জুলাই ঘটলেও ১১ জুলাইয়ের আগে তেমন কোনো সংবাদ মাধ্যম বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেনি৷ পাথর ও ইট দিয়ে থেতলে হত্যার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পর সংবাদ মাধ্যম সরব হয়, সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে নিজেদের হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই নৃশংসতার পথ বেছে নেয় অপরাধীরা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা এই ধরনের একটি প্রবণতা দেখছি। কারণ অনেক মব ভায়েলেন্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যারা মব করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা প্রশংসিত হচ্ছে। আরো বড় অপরাধী হয়ে ওঠে।''
এতগুলো মানুষের উপস্থিতিতে এ ঘটনাটি ঘটল, কেউ এগিয়ে গেলো না কেনো? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তি যখন নিজেকে নিরাপদ মনে করে না তখন সে অন্যের বিপদে সরাসরি এগিয়ে যায় না। এখানে ব্যক্তির নিরাপ্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অপরাধের প্রতিবাদ করলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়। তাই সবাই নিজে নিরাপদ থাকতে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করে। কারণ সেখানে যে কিছুটা নিরাপদ মনে করে।''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. রেজাউল করিম বলেন,‘‘ কিছু মানুষ আছে যারা অপরাধ প্রবণ। তাদের বলা হয় লাইকলি অফেন্ডার। তারা অপরাধের সুযোগ খোঁজে৷ তারা সুইটেবল টার্গেট খোঁজে। তারা কখন অপরাধ করলে সেটা এফেকটিভ হবে তা বিবেচনা করে। তারা দেখছে অপরাধ করলে তারা পার পাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর তৃতীয়ত হলো লিগ্যাল গার্ডিয়ানশিপ। মনিটরিং, সার্ভিলেন্স, বিচার এগুলো ঠিক মতো হচ্ছে না। অপরাধের
কেউ স্বীকার করতে চায় না যে তার কারণে এটা হয়েছে। কেউ দায় দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। আবার কেউ দায় দিচ্ছে রাজনৈতিক দলকে। তারা আবার অস্বীকার করছে। তৃতীয়ত, ডিনায়েল দ্য ইনজ্যুরি। বলা হচ্ছে তার নিজের কারণেই সে হত্যার শিকার হয়েছে। সে নিজেও চাঁদাবাজ। চতুর্থত, কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। একটি রাজনৈতিক দল কথা বললে আরেকটি রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বলা হয় আপনি কথা বলার কে? সর্বশেষ, অ্যাপিল টু দ্য হায়ার লয়ালটি। তারা ওই নেতৃত্বকে খুশি করতে যেকোনো কাজ করে। আর নেতৃত্বও তাকে শেল্টার দেয়। এই পাঁচটিই আমাদের এখানে বিদ্যমান।''
অপরাধীদের নৃশংসতা আর সাধারণ মানুষের নিস্ত্রিয়তাই নয়, মানুষ দলবদ্ধ সহিসংতায়ও জড়িয়ে পড়ছে৷ আর এই ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরাও৷
পুরনো ঢাকার ঘটনার পর ১১ জুলাই খুলনায় বহিষ্কৃত যুবদল নেতা মোল্লা মাহবুবুর রহমানকে হত্যা করা হয় নগরীর দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিম পাড়ায় তার নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তাকে গুলি করার পর তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে কুপিয়ে তার পায়ের রগ কাটা হয় হয় প্রকাশ্যে। কিন্তু এখনো পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। কুমিল্লায় তিন জুলাই সকালে মা মেয়ে ও ছেলেকে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দুর্বৃত্তরা ৫ এপ্রিল প্রকাশ্যে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের হিসেবে জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে সারা দেশে মব ভায়োলেন্স বা গণপিটুনির শিকার হয়ে ৮৯ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে ঢাকা বিভাগেই নিহত হয়েছেন ৪৫ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো, তৌহিদুল হক বলেন, ‘‘গণঅভ্যুত্থানের পরে রাষ্ট্র ও সমাজ যে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং আইনের শাসনের পথে হাঁটতে চায় সেই ব্যবস্থাগুলো আমরা দেখছি না। ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে।
, তার নিরপত্তা নাই। এই কারণে কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় মামলার সাক্ষীও হতে চায়না। একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। তারা আরো নৃশংস হচ্ছে৷'' সূত্র: ডয়েচে ভেলে।
আমাদের ঠিকানা।